প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে…

0
140

কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে প্রথম প্রেমের জোয়ার এনে দিয়েছিল বোম্বের এক মেয়ে, নাম আন্না তড়খড়; রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘নলিনী’। ঘটনা ১৮৭৮ সালের। এই প্রেমের গল্প বলেছেন কবি নিজেই। কৈশোরে বোম্বাইয়ের এক বাড়িতে কিছু দিন ছিলেন কবি। সেই বাড়ির এক শিক্ষিতা আধুনিকা তখনই বিলেত ঘুরে এসেছিলেন। তখন কবি নেহাতই অল্পবয়সি, পুঁথিগত বিদ্যার পুঁজি ছিল না, তাই সুবিধে পেলেই জানিয়ে দিতেন যে, তাঁর কবিতা লেখার হাত আছে। যার কাছে নিজের এই কবিত্বের কথা প্রকাশ করেছিলেন, তিনিও মেনে নিয়েছিলেন। কবির কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন একটা ডাকনাম, ভাল লেগেছিল আন্নার। আন্না বলেছিলেন, “কবি, তোমার গান শুনলে আমি বোধ হয় আমার মরণদিনের থেকেও প্ৰাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।” কবি লিখেছেন— ‘মনে পড়ছে তার মুখেই প্ৰথম শুনেছিলুম আমার চেহারার তারিফ। …একবার আমাকে বিশেষ করে বলেছিলেন, ‘একটা কথা আমার রাখতেই হবে, তুমি কোনোদিন দাড়ি রেখো না, তোমার মুখের সীমানা যেন কিছুতেই ঢাকা না পড়ে।’

১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি অতুলপ্রসাদ সেন ও দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে আলাপে রবীন্দ্রনাথ তরুণী আন্নার কথা স্মরণ করেছেন, ‘তখন আমার বয়স বছর ষোলো। আমাকে ইংরেজি কথা বলা শেখানোর জন্যে পাঠানো হলো বম্বেতে একটি মারাঠি পরিবারে।… সে পরিবারের নায়িকা একটি মারাঠি ষোড়শী।… যেমন শিক্ষিতা, তেমনি চালাক-চতুর, তেমনি মিশুক।… আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো করেই সে ঘুরত আমার আনাচে কানাচে। আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিতো সান্ত্বনা, প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে।’

এক চাঁদনি রাতে সে হঠাৎই এসে হাজির হয়েছিল কবির ঘরে। কবি তখন নিজের বাড়ির চিন্তায়, কলকাতার গঙ্গার চিন্তায় বিভোর।

কবি কী ভাবছে, জিজ্ঞেস করে সে বসে পড়ে কবির পাশে, কবির নেয়ারের খাটিয়াতেই। চিন্তামগ্ন কবির সঙ্গে কথাবার্তায় জুত না পেয়ে তরুণী আন্না প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘আচ্ছা, আমার হাত ধরে টানো তো— টাগ্-অফ-ওয়ারে দেখি কে জেতে?’

কবি তাঁর খেয়ালিপনার সঙ্গী হয়েছিলেন, পরে বলেছিলেন— ‘আমি সত্যিই ধরতে পারি নি, কেন হঠাৎ তাঁর এতরকম খেলা থাকতে টাগ্-অফ-ওয়ারের কথাই মনে পড়ে গেল। এমনকি আমি এ শক্তি পরীক্ষায় সম্মত হতে না হতে সে হঠাৎ শ্লথভাবে হার মানা সত্বেও আমার না হল পুলক-রোমাঞ্চ, না খুলল রসজ্ঞ দৃষ্টিশক্তি। এতে সে নিশ্চয়ই আমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বিশেষ রকম সন্দিহান হয়ে পড়েছিল।’

‘শেষে একদিন বলল, তেমনি আচমকা: “জানো কোনো মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার?” বলে খানিক বাদে আমার আরাম কেদারায় নেতিয়ে পড়ল নিদ্রাবেশে। ঘুম ভাঙতেই সেই চাইল পাশে তার দস্তানার দিকে। একটিও কেউ চুরি করে নি।’

রসশাস্ত্রের বিচারে আন্নাকে অনেকটা প্রগল্ভা নায়িকার পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে, কিন্তু তরুণ রবীন্দ্রনাথের কাছে না হলেও পরিণত রবীন্দ্রনাথের কাছে সে প্রেম যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করেছে।

আন্নার প্রেমকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকৃতি দিয়েছেন শেষ বয়সে। উপরোক্ত কথোপকথনের সূত্রেই তিনি বলেছিলেন, ‘কিন্তু সে মেয়েটিকে আমি ভুলিনি বা তার সে আকর্ষণকে কোনো লঘু লেবেল মেরে খাটো করে দেখিনি কোনো দিন।… একটা কথা বলতে পারি গৌরব করে যে, কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আমি কখনো ভুলেও অবজ্ঞার চোখে দেখিনি- তা সে ভালোবাসা যেরকমই হোক না কেন।… আমি বরাবরই উপলব্ধি করেছি যে প্রতি মেয়ের ভালোবাসা তা সে যে-রকমের ভালোবাসাই হোক না কেন— আমার মনের বনে কিছু না কিছু আফোটা ফুল ফুটিয়ে রেখে যায়— সে ফুল হয়ত পরে ঝরে যায়, কিন্তু তার গন্ধ যায় না মিলিয়ে।’

১৮৭৯ সালের ১১ নভেম্বর বরোদা কলেজের উপাধ্যক্ষ হ্যারন্ড লিটেল্‌ডলের সঙ্গে আন্নার বিয়ে হয়। আন্নার মৃত্যু হয় ১৮৯১ সালের ৫ জুলাই এডিনবরা শহরে। লক্ষণীয়, বিবাহিত জীবনেও আন্না রবীন্দ্রনাথকে ভোলেননি। সেই কিশোর-কবির প্রদত্ত আদরের ডাকনাম ‘নলিনী’ স্বাক্ষরেই তিনি প্রবন্ধাদি প্রকাশ করতেন। এই তথ্যটিও উল্লেখ্য, তাঁর এক ভ্রাতুষ্পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ।